শৈশবঃ ফেলে আসা দিনের স্মৃতিগুলো (পর্ব- এক)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০১:৩৮:০১ রাত
" ছায়া ফেলে যায় তবুও নিঃসময়
তারই মাঝখানে লহমার এই দেখা
একার সঙ্গে মুখোমুখি হল একা।" ১
সবার মাঝে থেকেও কখনো কখনো বেশ একা লাগে। সেই একাকীত্বকে কাটাতে কত কিছুই না করা। ইচ্ছেঘুড়ি শত সহস্র আলোকবর্ষ ঘুরে আসে, তবুও ঘুচে না নিঃসঙ্গতা। কারণ সেই ঘুরে আসাটা থাকে বর্তমানকে সাথে নিয়ে কেবলি সামনের দিকে। তাই অতৃপ্তি ঘুচে না। তখনি হৃদয়ের গহীন কোণ থেকে ডাক শুনতে পাই
' তোমার কিসের অভাব খোকা?
ইচ্ছে হলেই পাও কাছে সব
জুঁই জোনাকি পোকা।
তোমার আছে সবুজ পাহাড়
ফুলের বাহার, নদী-
তোমার বুকে যাক না বয়ে
জোয়ার নিরবধি।'২
মুহুর্তে এই বুড়ো খোকা মাইকেল জে ফক্স হয়ে ফিরে যায় সোনালী অতীতে- হিরণ্ময় অতীত- হীরের কুঁচির মত জ্বলজ্বলে আমার শৈশব সকল অতৃপ্তি মিটাতে আমাকে কাছে টেনে নেয়! যদিও এই ডিজিটাল যুগের নিরিখে সাদা-কালো ক্যানভাসে অনেকটা বিবর্ণ আমার শৈশব! দেখা যাক, কেমন ছিল সেই ক্যানভাস...
[আমার শিশুবেলার একমাত্র দুর্লভ ছবি। মায়ের কোলে আমি, নভেম্বর, ১৯৭১ ইং]
শৈশবের প্রথম স্মৃতিঃ
কোথায় যেন পড়েছিলাম, এল এস ডি নামের একটি ড্রাগ রয়েছে, যা সেবনে হ্যালুসিনেশন এর প্রভাবে মানুষ তার মাতৃগর্ভের স্মৃতিকে পর্যন্ত মনে করতে পারে। আমার কাছে এটি অবাস্তব মনে হয়। আমি আমার চেতনায় শৈশবের প্রথম স্মৃতি যা দেখতে পাই, সেটি আমার দাদা বাড়ির ঘটনা। আমি আমার চাচার কোলে... তন্ময় হয়ে দেখছি আগুনের লেলিহান শিখা। রাতের বেলা... দাদা বাড়ির পাশের বাড়িতে আগুন লেগেছে... আকাশ ছুঁতে চাওয়া আগুনের শিখাগুলির প্রলয় নৃত্য সেদিনের এক শিশুর মানসপটে আজো ভেসে বেড়ায়। নিজেকে এতো শক্তিধর ভাবা মানুষ, কিছু প্রাকৃতিক ভৌত বস্তুর সামনে কিভাবে অসহায় হয়ে আত্মসমর্পণ করে, সেদিন আমার অবচেতন মনে গেঁথে গিয়েছিল।
নানা বাড়ির স্মৃতিঃ
জীবনের একেবারে প্রারম্ভিক পর্যায়ে চাকরির সুবাদে আমার আব্বা খুলনায় একটি মেসে থাকতেন। আমি আম্মার সাথে নানা বাড়িতে। জীবনের মধুর সময়গুলো আমার সেখানেই কেটেছে। হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। পটে আঁকা ছবির মত। প্রাচীন জমিদারদের মত সিমেন্টবিহীন লাল ইটের চুনামাটির প্রলেপে বানানো একটি বাড়িতে আমার জন্ম। সেই ইটগুলো যায়গায় যায়গায় গাঁথুনির চুনা ঝরে যাওয়াতে ফোঁকর দৃশ্যমান ছিল। সেই ফোঁকরগুলো আরো গভীর করাতে আমার প্রচেষ্টার কমতি ছিল না। আজ আমার ছোট বাবুকে দুষ্টুমি না করার জন্য যখন উপদেশ দেই, আড়ালে থেকে আমার শৈশবের সেই 'আমি' মুখ ভেংচায়।
দিনভর খালের পাড়ে মাটির প্রধান রাস্তায় অন্যান্য খালাতো-মামাতো ভাই বোনদের সাথে খেলায় খেলায় কাটত। কত রকমের খেলা যে ছিল। কিছু কমন খেলার ভিতরে রান্না-বান্না, পুতুলের বিয়ে আর দোকানদারি করার খেলাটাই বিশেষভাবে মনে পড়ে।
তখনো সাঁতার শিখি নাই। কিন্তু তাতে কি? খালে যখন ভাঁটা থাকে, তখন দলবেঁধে সবাই নেংটো হয়ে কাদা পেরিয়ে তাল গাছের ঘাটলার সর্ব শেষ ধাপে অবস্থান নেই। কোমর সমান পানিতে হাবুডুবু খাবার সেই নষ্টালজিক অনুভূতির কাছে, এখনকার সকল অনুভূতিকে তুচ্ছ মনে হয়। আজ ইট পাথরের নগর জীবনে পার্কের স্লীপারে আমার কন্যাদের যখন আমোদে মেতে উঠতে দেখি, তখন খালের পাড়ে নিজেদের তৈরী মাটির স্লিপারে নগ্ন 'আমি'র উচ্ছলতাকে মনে পড়ে। পানি ছিটিয়ে ঢালু খালের কর্দমাক্ত সেই প্রাকৃতিক স্লীপারে যে আনন্দ পেয়েছি, আজ আমাদের সন্তানেরা কল্পনায়ও আনতে পারবে কি? ভাটার সময় খালের কাদার ভিতরে 'ডগরা' মাছ ধরার সেই আনন্দঘন মুহুর্ত বড্ড মিস করি। এখনকার হাজার টাকা দিয়ে টিকেট কিনে পুকুরে হুইলে মাছ ধরার আনন্দ শৈশবের সেই হাত দিয়ে মাছ ধরার তুলনায় বড্ড পানসে লাগে।
নানাবাড়ির অন্দর মহলের পুকুর ঘাটটিও আমাকে বেশ টানত। সেখানে তিন মামার জন্য আলাদা তিনটি ঘাটলা ছিল। মহিলাদের জন্য একেবারে ঘেরা। সেই লাল ইটের পলেস্তারাবিহীন ঘাটলাকে আমার কংকালের মত দাত বের করা হাসিমুখ মনে হত। আসলে এখনকার সময়কে যদি আধুনিক ধরা যায়, তবে আমার শৈশবে তখন নানাবাড়ির জৌলুস ভগ্নপ্রায় প্রাচীনতাকে ধারণ করে মধ্যযুগে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
আমার হাতে খড়িঃ
আমার হাতে খড়ি হয়েছিল আমার নানার হাতে। তখন কালো স্লেটের চল থাকলেও তাল পাতার চিকন ফালি করা খাতায় বাঁশের কলম কয়লা গুড়ো করে বানানো কালিতে চুবিয়ে লিখতে হত। আর এক টুকরো কাপড় রাখা হত কালির লেখা মুছবার জন্য।এখন যে প্রাইমারি স্কুলগুলোতে কিংবা কিন্ডারগার্টেনে সবাই বি-সিরিয়ালের রেডিমেড সুদৃশ্য পেন্সিলের ব্যবহারে সিদ্ধহস্ত, আমাদের সময়ের সেই বাঁশের কলম দিয়ে তালপাতায় লেখার সুখানুভূতি কি আদৌ পাওয়া সম্ভব? একটা ছোট হোগলার মাদুর সাথে নিয়ে যেতাম টো্লে। একজন হিন্দু পন্ডিতমশাই ছিলেন আমাদের সকল শিশুদের একমাত্র শিক্ষক। সেখানে আমার আসল হাতে খড়ি বেশ জাকজমকের সাথে হল। তখন এই বিশেষ অনুষ্ঠানগুলোতে বাতাসা, খই, চিড়া ভাজা ছিল প্রধান উপকরণ। অন্যান্য ছাত্ররা সহযোগে এক মহাউৎসব পালন হত। আমরা মাটিতে মাদুর বিছিয়ে লেখাপড়া করতাম। ওহ! সেই দিনগুলি!!
প্রতিদিন সকালে ফজরের সময়ে উঠে নানার কাছে আরবি শিখতাম। এরপরে আদর্শলিপি থেকে নানা আমাদের সকল ভাই-বোনদেরকে মুখস্ত করাতেন খুবই কমন কিছু কবিতা-
" সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারাদিন যেন আমি ভাল হয়ে চলি।"- কিংবা
" পারিব না একথাটি বলিও না আর
কেন পারিবে না তাহা ভাব একবার।"- অথবা
" পাখি সব করে রব রাতি পোহাইলো
কাননে কুসুম কলি সকলি ফুটিল"- কি বন্ধুরা, মনে পড়ে? [আমার সমবয়সী যারা তাদেরকে বন্ধু সম্বোধন করেছি]
তখন গ্রামে চাষাবাদই ছিল একমাত্র জীবিকা। অনেক কামলা কাজ করত। তাদেরকে সকাল বেলা এক গামলা পান্তা ভাত অবাক বিস্ময়ে খেতে দেখতাম! লাল আউশ চালের ভাত সরিষার তেল, পিয়াজ এবং পোড়া মরিচ ডলে ভাতগুলোকে আরো লাল করে ফেলে তাদের সেই তৃপ্তিকর খাবার দৃশ্য এখনো আমার জিভে জল এনে দেয়! আর দায়ে কাটা তামাক চিটা গুড় সহযোগে হুক্কায় দম দেবার এবং হুক্কার নারিকেলের খোলে পানির ভিতর থেকে বের হওয়া সেই অদ্ভুদ শব্দ এখনো কানে বাজে [যদিও হুক্কা পান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, তাই বিষবৎ পরিত্যাজ্য]
আর একটি জিনিস উল্লেখ করে এই পর্বের ইতি টানবো। ধান কাটার মওশুমে ধান কাটা হয়ে গেলে কিছু ধান মাঠে পড়ে থাকতো। ছোটরা দলবেঁধে সেই ধান টোকাতে যেতাম। এতোটা দুষ্টু ছিলাম যে, অনেক সময় ক্ষেত থেকে ধান গাছের উপরের শীষ কেটে নিয়ে যেতাম। যদিও এখন বুঝি যে, সেই কাজটি ছিল এক ধরণের চোর্য্যবৃত্তি। তবুও কি এক উদ্দাম নেশায় সেই কাজটিও সকলে করতাম। এ ছাড়া ইদুরের গর্ত থেকেও ওদের জমানো ধান বের করে নিয়েছি। এই কাজটি অনেক বিপদজনক ছিল। প্রায় ইঁদুরের গর্তেই সাপ থাকার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে ভয় ডর বলে কিছু ছিল না। এই জমানো ধান চলে যেতো ভ্রাম্যমান খই, মুড়ি, মুড়কি বিক্রেতার ঝোলায়। এরা ধান কাটার সময় এলে বাড়ি বাড়ি এসে ওদের জিনিসগুলোর পরিবর্তে ধান নিয়ে যেতো। এখানেও নানীর গোলা থেকে ধান চুরি করে এনে কত মোয়া নিয়েছি। আজ নিজেকে বড্ড চোর মনে হচ্ছে। কিন্তু সেই সাথে কি একটুও আফসোস হচ্ছে না? থেকে থেকে কি মনটা আবারো সেই 'না বলে নেয়ার' মুহুর্তগুলিতে ফিরে যেতে চাচ্ছে না? হৃদয়ের তন্ত্রীতে কেবলি বেজে উঠছে ওয়ারফেজ এর সেই গানটি-
"... আজো ভুলিনি সেই দিনগুলি
মনে পড়ে যায় আবারো ফিরে আসে..."
(ক্রমশঃ)
---------------------------------------------------------------
১ ( কবিতাঃ দেখা, কাব্য গ্রন্থঃ হাসিখুশি মুখে সর্বনাশ, কবিঃ শঙ্খ ঘোষ)
২ (রাশেদ রউফঃ বাংলাদেশের খোকা তুমি)
বিষয়: সাহিত্য
১৬৬১ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
যা মনে আসছে, লিখে যাচ্ছি।
সাথে থাকার জন্য শুভেচ্ছা রইলো।
আসলে আমরা যারা ১৯৭১ ইং বা কাছাকাছি সময়ে সেই সাদা-কালো যুগের প্রজন্ম, আমাদের সকলের শৈশবই প্রায় একই ধরণের। তাই যে কারো স্মৃতিগাঁথাকে বড্ড নিজের মনে হয়।
ধন্যবাদ আপনাকে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
আসলে মনের চোখ দিয়ে যখনি নিজেকে দেখার চেষ্টা করি, কিভাবে যেন অনেক গভীরে হারিয়ে যাই।
আপনার ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি, যেন সাথে থেকে এভাবে উৎসাহ দিয়ে যেতে পারেন। আপনার নিজের লেখারও অপেক্ষায় রয়েছি। আশা করি বেশী অপেক্ষা করিয়ে রাখবেন না।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
সুন্দর বলেছেন।
শুভেচ্ছা রইলো।
সাথে আছেন, অনুভূতি রেখে যাচ্ছেন, অনেক ভালো লাগছে।
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
শুভেচ্ছা রইলো।
অনেক অনেক শুভেচ্ছা ।
এবার আমাদেরকে আপনার স্মৃতি থেকে সেই নস্টালজিক মুহুর্তগুলো তুলে এনে একটু ভালোলাগার আবেশে জড়িয়ে নিন।
অপেক্ষায় রইলাম ভাই...
অনেক অনেক শুভেচ্ছা আপনার জন্য।
সহমত আপনার সাথে।
ভালো রাখুক আল্লাহপাক আপনাকে সবসময়।
অনেক শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন